বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১২

শরীরের জন্য ইমোশনাল ডিপেন্ডেন্সি অপ্রয়োজনীয়


পেশায় সাংবাদিক, ন’ বছরের মেয়েকে নিয়ে এ শহরে নিজের মতো করে বেঁচে আছে অবিবাহিতা এই মা, নয়না।
মা হতে গেলে কেন বিয়ে করতে হবে? ‘দিস ইজ টু মাচ’। আমার দিকে শান্ত অথচ দৃপ্ত স্বরে বলল নয়না। নয়নাকে দেখে একটুও বোঝা যায় না ওর ন’ বছরের মেয়ে থাকতে পারে। ‘আসলে আমার জীবন কোনওদিনই বাঁধা ছকের মধ্যে দিয়ে বইল না। বেশ খানিকটা খোলামেলা আবহাওয়ায় বেড়ে উঠলেও স্কুলের গন্ডি পেরলেই বাবা আমায় বাধ্য করেন কমার্স পড়ার জন্যে। কিন্তু আমার বরাবর-ই আর্টসের দিকে ঝোঁক ছিল। কী আর করি, কলেজে ভর্তি হয়েও বেরিয়ে আসি। গ্র্যাজুয়েট হওয়াও আর হল না আমার।

ami agami

কলেজ যাওয়ার বয়সেই বেশ একটা জম্পেশ প্রেম হল। বেশ কাটত আমাদের দিন- সন্ধে, খেলায় খেলায় পর পর দুবার কনসিভও করে গেলাম। যেরকম পরিস্থিতি ছিল, তাতে তখন বাচ্চা আনতে আমরা কেউই চাইনি। আমি আমার লেখালেখি, বন্ধু, প্রেম নিয়ে বেশ ছিলাম। বাড়িতে সবাই বলত আমি বিয়ে ব্যাপারটাকেই বিশ্বাস করি না, তাই বিয়ে করছি না। আসলে তা একেবারেই নয়। বিয়ে করে যার সঙ্গে থাকব, তাকে আজও খুঁজে পাইনি। বিয়ে তো শুধুমাত্র আমাকে দিয়েই চলত না। লোক চাই, তাই বিয়ে হল না। সম্পর্ক যে হয়নি এমনটাও নয়। কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে যখন বুঝতে পেরেছি আমি এটা বয়ে বেড়াতে পারব না, তখন সঙ্গে সঙ্গে সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমি মনে করি এই বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি। মধ্যবিত্তর স্পেসে যা সচরাচর হয় না। বাঙালি মেয়েরা তৈরি-ই হয় পরনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে। এটা খুব বিপদের। যা কিছু ছেড়েই তারা আজ বেরিয়ে যাক না কেন, ইমোশনাল ডিপেন্ডেন্সি থেকে তারা আজও বেরতে পারে না।
তিরিশে এসে আবার হঠাৎ মা হলাম। মা হওয়াটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার ছিল, মানে আমি বলতে চাইছি আমি মা হতে চাই কী না? তিরিশে পা দিয়ে হঠাৎ-ই যেদিন বুঝলাম আমি মা হব, তখন সেই আনন্দ নিজের মধ্যে নিয়ে রাখলাম। মা হওয়ার ইচ্ছে আমার বরাবরই ছিল। আমার পার্টনার কোনওদিন আমার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি, আর সেই কারণেই আমরা দুজনে দুজনকে ভুলতে চাইলাম। কোনও বন্ধনহীন শর্তে আমরা দুজনে জীবন কাটাব- এমনটা ভাবলেও কেন জানি না সেই দিন আবার আগের মত ক্লিনিকে গিয়ে অ্যাবর্ট করার কথা ভাবতে পারিনি। চলে গেলাম দিল্লিতে আমার দাদা-বউদির কাছে। ওখান থেকেই শুরু হল আমার নতুন পথ চলা। বিয়ে করাও আর হল না আমার।
দিল্লিতেই কাজ করতে করতে আনন্দীর জন্ম হল। কেউ জানত না। অফিসে, বাড়ি ফেরার রাস্তায় আমার পেটের দিকে তাকিয়েই আমি কেমন আছি জানার পরেই সকলেই যে প্রশ্নটা করত, সেটা হল- ওর বাবা কোথায়? আজও অফিসে মেয়ের কথা এলেই প্রথমে আসে ওর বাবার কথা। যখন বলি, বাবা নেই, আমি সিঙ্গল পেরেন্ট হিসেবেই ওকে মানুষ করছি, বেশিরভাগ লোক-ই কেমন করে ছানাবড়ার মত চোখ নিয়ে তাকায়, আর মহিলারা ঢোক গেলে। শহর পাল্টালেও মানুষের মন কী করে পাল্টাব?
আনন্দীর জন্মের দু’ মাস পরে আমার মা-বাবাকে খবর দিলাম। প্রথমে তো একটু ঝামেলা হয়েইছিল, কিন্তু কলকাতায় নেমে বাড়ির মাধবীলতা জড়ান গেটের গায়ে যখন একদল মামা, মাসিদের হাসি মুখ দেখলাম, তখন মনে হল এটাই তো সহজ ছবি, কারণ এটাই আজ আমার সবচেয়ে বড় সত্য।
আনন্দীর সাত বছর বয়সে ওকে বলে দিয়েছিলাম, ও কীভাবে এসেছে আমার কাছে। ওকে এমন ইংরেজি ছবি দেখাতাম, বই পড়াতাম, গল্প বলতাম যেখানে অন্য সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে। এমন কি ‘আন ইউসুয়াল বা ডিফারেন্ট লিভ ইন-এর কথা সহজভাবে ওকে বলতে থাকতাম। ওর কোনও অসুবিধাই হয়নি। প্রথম থেকেই আনন্দীর কাছে এটাই স্বাভাবিক ছিল, ও জানত মা, দাদু, দিদাকে নিয়েই ওর ফ্যামিলি। একবার খুব মজা হয়েছিল স্কুলে, ওদের ফ্যামিলি ডে-তে দুটো কার্ডের অর্থাৎ বাবা আর মায়ের জন্যে ইনভাইট পাওয়ায় আমার আপাত গম্ভীর মুখ দেখে বলেছিল ‘মা তুমি কিছু ভেব না, ওটা তো ওপেন ফোরাম- আমরা ডিউকে নিয়ে চলে যাব’। ডিউ আমাদের কুকুর। আসলে ও ম্যানেজ করে নেয়।
ওকে বলেওছি, ও আর একটু বড় হোক, ইফ হি ওয়ান্ট টু মিট দ্যাট ফেলো- আমি ওকে বাধা দেব না। মেয়েরা নিজেদের ইন্ডিপেনডেন্ট বলে লাফায়, কিন্তু আজও দেখি আইলাইনার কেনার টাকা বরের পকেট থেকেই চুরি করে।
ভাল লাগল নয়নাকে। ওর অফুরান শক্তি আমায় জানিয়ে দিল- নিজেদের সহজভাবে জীবনের হাতে, মনের ইচ্ছায় ছেড়ে দিতে হবে। জোর করে একলা থাকার অভ্যেস নয়, রক্তমাখা চরণতলে একলা চলার মন ইচ্ছে জাগিয়ে নিয়ে পথে নামতে হবে।
    [ উৎসঃ ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপরে ফিরে আসুন Blogger Widgets