সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

চলে গেলেন 'কিং অফ রোমান্স'


হিন্দি ফিল্মের ইতিহাসে ‘রোমান্স’ শব্দটির অর্থ পাল্টে দিয়েছেন যিনি, তিনি হলেন ইয়াশ চোপড়া। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সাফল্যের সঙ্গে শুধুমাত্র রোমান্টিক সিনেমা নির্মাণ করে নিজের একটি আলাদা ‘ব্র্যান্ড’ সৃষ্টি করেছিলেন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। ইয়াশ রাজ ফিল্মসের কর্ণধার এই গুনী নির্মাতাকে সবসময় ধরা হয়েছে সম্পূর্ণ বলিউড ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে। তবে এই অসাধারণ প্রেমের কারিগর চলে গেছেন এই ইহলোক ত্যাগ করে। গত ২১ অক্টোবর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিনিয়র এই বলিউডি নির্মাতা।


চলচ্চিত্র নির্মাতা আদিত্য চোপড়া এবং অভিনেতা উদয় চোপড়ার বাবা ইয়াশ চোপড়া এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর নিজের আশিতম জন্মদিন পালন করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই অক্টোবরের ১৩ তারিখ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাই-এর লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন খ্যাতিমান এই পরিচালক-প্রযোজক।
ইয়াশ চোপড়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লাহোরে। আট ভাইবোনের মধ্যে এক ভাই বি আর চোপড়া যখন একজন সফল পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করলেন, তখনই যুবক ইয়াশ নিজের মনের ভেতর দীর্ঘদিন ধরে লালিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার স্বপ্নটি পূরণ করার অনুপ্রেরণা নতুন করে খুঁজে পান। আর তাই বাবা মায়ের ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ইচ্ছাকে পেছনে ফেলে মাত্র ২০০ রুপি সঙ্গে নিয়ে মুম্বাই পাড়ি জমান তিনি। ১৯৫৯ সালে তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ধূল কি ফুল’ মুক্তি পায়। সামাজিক ড্রামাধর্মী এই সিনেমাটি সমালোচক এবং দর্শক- উভয়মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পায়।


১৯৬৫ সালে ‘ওয়াক্ত’ সিনেমার জন্য প্রথমবারের মত শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার পান ইয়াশ চোপড়া। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে লাগাতার সুপারহিট সিনেমা নির্মাণ করার ফলে ১৯৭১ সালে যখন ইয়াশ চোপড়া তার নিজস্ব প্রোডাকশন ‘ইয়াশ রাজ ফিল্মস’ কোম্পানি খুললেন, তখন ইয়াশ চোপড়ার সিনেমা যেন একটি আলাদা ব্র্যান্ডের মর্যাদা পেল। তখন থেকে আজ পর্যন্ত, ইয়াশ রাজ ফিল্মসের ব্যানারের সকল সিনেমাকে চোখ বন্ধ করে সুপারহিট বলে রায় দিতে থাকেন সিনেমা বোদ্ধারা।

আশি বছর বয়সি ইয়াশ চোপড়া বলিউডকে যে সব সৃজনশীল সিনেমা উপহার দিয়েছেন, তার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসায়িক এবং সমালোচক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে সেরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের ‘দিওয়ার’। ইয়াশ চোপড়ার এই থ্রিলার ধাঁচের সিনেমাটি অমিতাভকে এনে দিয়েছিলো ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ এর বিখ্যাত খেতাব।


ইয়াশ চোপড়া এবং অমিতাভ বচ্চনের এই জুটি এক সময় বলিউডের পর্দা কাঁপিয়েছে এবং সেই সঙ্গে বলিউডকে উপহার দিয়েছে ‘সিলসিলা’, ‘কাভি কাভি’ এবং ‘ত্রিশুল’এর মত কালজয়ী সিনেমা।


যদি শাহরুখ খানকে বলা হয় বলিউডের ‘কিং’ অর্থাৎ রাজা, তাহলে ইয়াশ চোপড়াকে বলতে হবে ‘কিং মেকার’ অর্থাৎ ‘রাজার সৃষ্টিকর্তা’। ১৯৯৩ সালে ইয়াশ চোপড়া পরিচালিত ‘ডর’ সিনেমায় অভিনয় করেই প্রথম তারকা খ্যাতি পান শাহরুখ খান; এরপর থেকে এই ‘ইয়াশ রাজ ফিল্মস’-এর সঙ্গেই একের পর এক হিট সিনেমার জন্ম দিয়ে তিনি হয়েছেন বলিউডের ‘কিং’। শাহরুখের সবচেয়ে বড় হিট সিনেমা ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ও মুক্তি পেয়েছিলো এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। পরবর্তীতে ইয়াশ চোপড়া শাহরুখ খানের সঙ্গে জুটি গড়ে আরও বেশ কিছু হিট সিনেমা নির্মাণ করেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘মোহাব্বাতে’, ‘বীর-জারা’ এবং সর্বশেষ ইয়াশ চোপড়া পরিচালিত সিনেমা ‘যাব তাক হ্যায় জান’, যেটি এখনও মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

শাহরুখ খান অভিনীত ‘যাব তাক হ্যায় জান’ সিনেমাটি ছিল ইয়াশ চোপড়ার পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা; এতে আরও অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী ক্যাটরিনা কাইফ এবং আনুশকা শর্মা। এই সিনেমাটির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনা থেকে অবসর নিয়েছিলেন এই প্রবীণ পরিচালক। সিনেমাটি আরও একটি কারণে ইয়াশ চোপড়ার কাছে ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এই সিনেমাটির মাধ্যমে দীর্ঘ নয় বছর পরে আবারও কোনো সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন ইয়াশ চোপড়া। ‘কিং অফ রোমান্স’ হিসেবে খ্যাত ইয়াশ চোপড়ার চিরাচারিত প্রেমের ধাঁচের  সিনেমায় শাহরুখও ফিরে পেয়েছেন তার পুরনো ‘রোমান্টিক হিরো’র চরিত্র। এরকম সব কারণেই এবছরের দিওয়ালীতে অর্থাৎ নভেম্বরের ১৩ তারিখে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘যাব তাক হ্যায় জান’কে বলা হচ্ছে এ বছরের সবচাইতে কাংখিত সিনেমা।


ইয়াশ চোপড়া তার দীর্ঘ সময়ের ফিল্মি ক্যারিয়ারে মোট ২২ টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। প্রযোজনায় কাজ করেছেন অনেকদিন। নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ পর্যন্ত পেয়েছেন ২ টি জাতীয় পুরষ্কার, এগারোটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। ২০০৫ সালে ইয়াশ চোপড়া পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ পদক। গুনী এই নির্মাতার মৃত্যু পুরো বলিউডের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপরে ফিরে আসুন Blogger Widgets