চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
|
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা (বাংলাদেশ গেজেট সোমবার আগষ্ট ২৯, ২০০৫) |
|
বাঙালি
জাতির হাজার বছরের ইতিহাস অধিকার আদায়ের সংগ্রাম মুখর। দেশের
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জনপদ চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষের ও রয়েছে
এই মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হবার গৌরবময় ইতিহাস। বৃটিশ শাসনের সূচনা কাল হতেই
ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার মতোই তৎকালীন নদীয়া জেলার অন্তর্ভূক্ত
চুয়াডাঙ্গার মানুষও অগণিত বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। |
|
তিতুমীর
পরিচালিত ওহাবী আন্দোলন থেকে শুরু করে ফরায়েজী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ,
স্বদেশী ও খেলাফত আন্দোলন। পরবর্তীতে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন চূড়ান্ত
রুপে ব্রিটিশদের উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য করে। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান
নামক দুটি নতুন রাষ্ট্রের। সবটাতেই ছিল চুয়াডাঙ্গা বাসীর স্বতস্ফূর্ত
অংশগ্রহণ।
এর পর শুরু মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার ভাষা আন্দোলন নিয়ে। ২১
ফেব্রুয়ারীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী মিছিলের তৈয়বুর, মহিউদ্দি প্রমুখ এই
চুয়াডাঙ্গারই সন্তান।এই ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ করেই চুয়াডাঙ্গা বালিকা
বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রথমবারের মতো রাজপথে নেমে আসে,অংশগ্রহণ করে
বিক্ষোভমিছিল ও ধর্মঘটে। একে একে আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন,
|
 |
|
১৯৬৬ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে রচিত আওমী লীগের ৬ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তুরের গণঅভ্যুথ্থান।
১৯৭০
সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সারাদেশের মতোই
চুয়াডাঙ্গাবাসী জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদে আওমী লীগ মনোনীত ব্যারিস্টার বাদল
রশীদ (জাতীয় পরিষদ), ডাঃ আসহাব-উল হক (প্রাদেশিক পরিষদ, চুয়াডাঙ্গা-১) ও
অ্যাডভোকেট ইউনুস আলী (প্রাদেশিক পরিষদ, চুয়াডাঙ্গা-২) -দেরকে বিপুল ভোটে
নির্বচিত করেন। ৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া হঠাৎ করেই নবগঠিত জাতীয় পরিষদের
আহুত অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষনা করেলে চুয়াডাঙ্গাতেও
বিক্ষোভ মিছিল ও হরতার পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন শোনার পর হতেই
চুয়াডাঙ্গায় শুরু হয় প্রতিরোধের প্রস্ত্ততি ।
|
২৫
মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা
অনুয়ায়ী বাঙালি হত্যায় মেতে ওঠে। চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি
ডাঃ আসহাব-উল হকের বাড়িতে একাধিক টেলিফোনে ঢাকা পতনের খবর আসে। গ্রেফতার
এড়াতে তিনি বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যান। চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের
সাধারণসম্পাদক অ্যাডভোকেট ইউনুস আলী রাত সোয়া একটায় ই.পি.আর-এর অয়ারলেসে
ধরা বঙ্গবন্ধুর একটি বার্তা পান, যেখানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন
দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে পাকিস্তানি
বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহবান জানান।
|
|
|
 |
|
২৬
মার্চ সকালে ঢাকার গণহত্যার খবর চুয়াডাঙ্গায় ছড়িয়ে পড়লে সবার মধ্যে আতন্ক
ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আগের রাতেই যশোর সেনানিবাস হতে একদল সৈন্য কুষ্টিয়া শহর
দখল করে নেয়ায় চুয়াডাঙ্গাবাসী তাদের শহরকে রক্ষার জন্য শহরের প্রবেশ
পথগুলোতে গাছের ডাল কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেই সাথে মহকুমার
বিভিন্ন এলাকা থেকে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছা সেবকদের শ্রীমন্ত টাউনহলে
একত্রিত করে চুয়াডাঙ্গা ট্রেজারি থেকে সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের মধ্যে
বিলিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করা হয়। |
|
১৯৭১
সালে ই.পি.আর ৪ নং উইং-এর সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গায় ছিল এবং সৌভাগ্য বসত সেই
সময়ে উইং অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সহ কয়েক জন বাঙালি অফিসার সেখানে
কর্মরত ছিলেন। ইতোমধ্যে ৬ মার্চেই অ্যাডভোকেট ইউনুস আলীর সাথে মেজর আবু
ওসমান চৌধুরীর গোপন বৈঠক হয় এবং তিনি ভবিষ্যতে সব ধরনের সহযোগীতার আশ্বাস
দেন। ২৫ মার্চ রাতে অফিসের কাজে তিনি কুষ্টিয়ায় অবস্থান করায় ২৬ মার্চ
পাকিস্থানি বাহিনীর নজর এড়িয়ে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসেন। এদিকে ঢাকার পিলখানা ও
রাজারবাগের মর্মান্তিক ঘটনা জানার পর ২৬ মার্চেই উইং হাবিলদার মেজর মজিবর
চুয়াডাঙ্গা ই.পি.আর সদর দপ্তরের সকল অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে অস্ত্রাগার
থেকে সব অস্ত্র-গোলাবারুদ সরিয়ে রাখেন। |
 |
|
সেই
দিন বিকেলেই স্থানীয় এক জরুরী সভায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে অধিনায়ক, ডাঃ
আসহাব-উল হককে প্রধান উপদেষ্টা এবং ব্যারিস্টার বাদল রশীদ ও অ্যাডভোকেট
ইউনুস আলীকে উপদেষ্টা করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড
গঠন করা হয়। ২৭ তারিখ সকালে ই.পি.আর হেড কোয়ার্টারে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর
নেতৃত্বে পাকিসআনি পতাকা নামিয়ে সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় বাংলাদেশের পতাকা
উত্তোলন করা হয়। আবু ওসমান চৌধুরী তার এক লেখায় লিখেছেন,”আমাদের
বর্তমান করণীয় ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাইরে অপেক্ষমান
উত্তাল জনসমুদ্রের হুন্কার আমাকে বুঝিয়ে দিল আমার মূলধন শুধু ই.পি.আর
বাহিনী ও তাদের ৩০৩ রাইফেলই নয়, আমার চূড়ান্ত হাতিয়ার বাংলার স্বাধীনতাকামী
আপামর জনসাধারণ, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেই” |
|
চুয়াডাঙ্গায়
প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয় ২৭ মার্চ। সেদিন চুয়াডাঙ্গা ই.পি.আর ৪র্থ উইং-এর
পলায়ন রত অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন বাঙালি ই.পি.আর সৈন্যদের নিরস্ত্র
করার উদ্দেশ্যে সরাসরি সীমান্তবর্তী যাদবপুর ফাঁড়িতে গিয়ে কর্তব্যরত
প্রহরীদের সাথে বচসায় লিপ্ত হলে এক পর্যায়ে সেই ক্যাপ্টেন প্রহরী সিপাহীকে
মেরে ফেলায় প্রতিশোধপরায়ন বাঙালি সৈন্যরা সেই ক্যাপ্টেনকে সদলবলে হত্যা
করে। এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদরদপ্তর চুয়াডাঙ্গাকে ঘিরে বিভিন্ন
ফ্রন্টে যুদ্ধ চললেও যুদ্ধাহতদের সেবায় কোন চিকিৎসা সেবার ব্যাবস্থা ছিলনা।
এমতাবস্থায় কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ ডাক্তারের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ও ভারতীয়
রেডক্রসের কাছ হতে পাওয়া সহযোগীতায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সদ্য নির্মিত
ভবনে হাসপাতাল চালু করা হয়। সেই যুদ্ধে আহতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ডাঃ
আসহাব- উল হককে চেয়ারম্যান ও ডাঃ শামসুজ্জোহা কোরেশীকে মহাসচিব করে
চুয়াডাঙ্গায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশ রেডক্রস (বর্তমান রেডক্রিসেন্ট) গঠন করা
হয়।
ক্রমান্বয়ে
বর্হিবিশ্বের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের কহটনৈতিক ও টেলিযোগাযোগ
ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য কহটনৈতিক
যোগাযোগ ও প্রচারণার উদ্দেশে উপদেষ্টা ব্যরিস্টার বাদল রশীদকে ২৭ মার্চে
ভারতে পাঠানো হয়। সেই সাথে ২৮ মার্চের মধ্যেই দর্শনা-ভারত ট্রেন লাইনের
রেল-টেলিফোনকে দ্রুত সংস্কার করে বর্হিবিশ্বের সাথে তারযোগাযোগ ব্যবস্থা
গড়ে তোলা হয় এবং সেই লাইনেই প্রথমে ডাঃ অসহাব-উল হক পশ্চিমবঙ্গেও
মূখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যয়ের সাথে কথা বলে সাহায্যের আবেদন জানান।
|
|
এদিকে
চুয়াডাঙ্গায় যখন অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তখন
পাশের জেলা কুষ্টিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পুরোপুরি অবরুদ্ধ। কিন্তু
পার্শ্ববর্তী জেলাকে এভাবে শত্রুর দখলে রেখে চুয়াডাঙ্গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের
নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। তাইতো চুয়াডাঙ্গায় বসে ডাঃ আসহাব-উল হক ও মেজর আবু
ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া শহরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী
দ্বারা চারদিক থেকে আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। এই প্রস্ত্ততিতে মেহেরপুরের
তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুর এলাকার সকল বাহিনীকে
একত্রিত করে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। সব প্রস্ত্ততি শেষ হলে ৩০ আর্চ ভোর
থেকে ’’ অপারেশন ফার্স্ট লেগ’’ নামের কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত করার আক্রমণ
শুরু হয়। দিনভর যুদ্ধ শেষে অনেক হতাহতের পর পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধার পর
পিছু হটে কুষ্টিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর
সহযোগীতায় কয়েক হাজার সাধারণ জনগণ এগিয়ে এসেছিল। |
 |
|
|
|
|
চুয়াডাঙ্গা
শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক
ও পরবর্তীতে সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দি অহমেদ ভারত গমনের উদ্দেশে
একমাত্র সঙ্গী ব্যারিস্টার অমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায়
পালিয়ে আসেন। তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলেচনায় চুয়াডাঙ্গার সার্বিক
পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সন্ধায় তিনি
জীবননগর উপজেলার চ্যাংখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
স্বাধীনতা
যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত থাকার সুবাদে ও
প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় চুয়াডাঙ্গাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের
রণাঙ্গনের অন্যতম সংবাদ উৎস।
|
|
 |
|
বিদেশী
সংবাদিকদের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা ডেটলাইনে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা
বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত
হয়। ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার উপর প্রথম বিমান হামলা চালানো হয়। এদিকে ১৯৬৫
সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে বন্ধ থাকা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার রেল
যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ৬ এপ্রিল চালু হয়। এদিকে
৬এপ্রিল ভোর বেলা পাকিস্তানি বাহিনী যশোহর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে
বিষয়খালিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা
পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।এর পর থেকে
ক্ষিপ্রগতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আকাশ ও জলপথে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও
অস্ত্রশস্ত্র যশোর সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। কিন্তু তখন পাকিস্তানি সেনাকে
বাধা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও জলযান মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আবু
ওসমান চৌধুরী লিখেছেন -“বিষয়খালী সঙ্ঘর্ষের পর থেকেই
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র যশোর
সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। সে সময় আকাশ ও জলপথে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা
দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র, বিমান বা জলযান কোনটাই আমাদের ছিল না। অসহায়ের
মতো দৈনন্দিন পরিস্থিতি ভারতের সমন্বয় অফিসারের কাছে টেলিফোনে জানিয়ে ভারি
অস্ত্রের জন্য তাগিদ দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করনীয় ছিল না।“
চুয়াডাঙ্গা
শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক
ও পরবর্তীতে সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দি অহমেদ ভারত গমনের উদ্দেশে
একমাত্র সঙ্গী ব্যারিস্টার অমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায়
পালিয়ে আসেন। তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলেচনায় চুয়াডাঙ্গার সার্বিক
পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সন্ধায় তিনি
জীবননগর উপজেলার চ্যাংখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
স্বাধীনতা
যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত থাকার সুবাদে ও
প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় চুয়াডাঙ্গাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের
রণাঙ্গনের অন্যতম সংবাদ উৎস। বিদেশী সংবাদিকদের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা
ডেটলাইনে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা
পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার উপর প্রথম
বিমান হামলা চালানো হয়। এদিকে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে বন্ধ থাকা
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলকর্মীদের অক্লান্ত
পরিশ্রমে ৬ এপ্রিল চালু হয়। এদিকে ৬এপ্রিল ভোর বেলা পাকিস্তানি বাহিনী
যশোহর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে বিষয়খালিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি
আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ
হয়ে যায়।এর পর থেকে ক্ষিপ্রগতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আকাশ ও জলপথে
ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র যশোর সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। কিন্তু
তখন পাকিস্তানি সেনাকে বাধা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও জলযান
মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আবু ওসমান চৌধুরী লিখেছেন -“বিষয়খালী
সঙ্ঘর্ষের পর থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও
অস্ত্রশস্ত্র যশোর সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। সে সময় আকাশ ও জলপথে
পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র, বিমান বা জলযান
কোনটাই আমাদের ছিল না। অসহায়ের মতো দৈনন্দিন পরিস্থিতি ভারতের সমন্বয়
অফিসারের কাছে টেলিফোনে জানিয়ে ভারি অস্ত্রের জন্য তাগিদ দেওয়া ছাড়া আমাদের
আর কিছুই করনীয় ছিল না।“
|
|
এদিকে
দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে সামরিক অফিসারের শূন্যতা পূরণের জন্য আবু ওসমান
চৌধুরী ৭ এপ্রিল সেক্টর অর্ডারের মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে অফিসার হিসেবে কাজ
করছিলেন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ঝিনাইদহের
এস.ডি.পি,ও মাহবুবউদ্দিন আহমদ ও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক
শফিকউল্লাহ এই ত্রীয় অফিসারকে সরাসরি কমিশন দিয়ে র্যান্ক পরিয়ে দেন।
|
 |
|
১০
এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত ভারতে উপস্থিত ২৮ জন এম.পি.এ-এর উপস্থিতিতে এক
সভায় অস্থায়ী সরকারের রাজধানী ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল
চুয়াডাঙ্গায় করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি নিরাপত্তা
জনিত কারণে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয় কিন্তুদ্রুতই তা বিভিন্ন সংবাদ
মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে পাকিসাতনি বাহিনীর জঙ্গি বিমান
চুয়াডাঙ্গার ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালাতে শুরু করে, সেই সাথে যশোর
সেনানিবাস থেকে শক্তিশালী একটি দল ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে
নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক লোককে হত্যা করে শহর দখল করে নেয়। দ্রুতই
দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়
।তথ্য মন্ত্রণালয় হতে প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ডে
প্রকাশিত সাক্ষাতকারে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বলেছেনঃ “মন্ত্রীসভার
আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের
জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনী সেখানে
বিমান থেকে বোমা বর্ষন করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে
আমাদের নতুন স্থানের কথা ভাবতে হলো” |
|
১৭
এপ্রিল। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন চুয়াডাঙ্গার
ই.পি.আর ৪নং উইংয়ের অধীন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা বি.ও.পির সন্নিকটে
আম্রকুঞ্জে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও
মুক্তিযুদ্ধাদের ব্যবস্থাপনায় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ
করেন এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সহযোগীতার আহবান
জানান।
|
 |
|
প্রাথমিক
অবস্থায় ই.পি.আর., বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, জনতার
বাংলাদেশী যোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ক্রমে পাকিস্থানি
বাহিনীর আক্রমণ তিব্র হলে পরিকল্পিত আক্রমণ ও গোলা বারুদের প্রয়োজন হয়ে
পড়ে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত করার
জন্য একক কমান্ড, সেই সাথে গেরিলা যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ শিবির ও প্রশিক্ষণ
কেন্দ্র গোড়ে তোলা। নেতৃবৃন্দের নির্দেশে বহু যুবককে সংগঠিত করে সীমান্তের
ওপারে নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগীতায় যুবপ্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়।
শুরু হয় পরিকল্পিত প্রতিরোধের প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন যুবনেতা
সোলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুন লিখেছেন-” নেতৃবৃন্দের নির্দেশ
মতো আমি চুয়াডাঙ্গার যুবক-তরুণদের একত্রিত করে ২২ এপ্রিল হৃদয়পুর শিবিরে
নিয়ে গেলাম। ১২০ জন ছেলে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম
ক্যাম্প চালু হলো”।
|
|
যুদ্ধ
পরিচালনা সুষ্ট ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১১ জুলাই বাংলাদেশের সমগ্র
যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাগণ যে
যেখানে যুদ্ধরত ছিলেন, তাঁকে সে অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঐ এলাকার
সমস্ত উপদলকে একক অধিনায়কত্বের আওতায় আনা হয়। চুয়াডাঙ্গা ৮নং সেক্টরের
অর্ন্তভূক্ত হয়। চলতে থাকে পাকিস্থানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে
সন্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ। ৫ আগস্ট চুয়াডাঙ্গাবাসীর জন্য একটি শোকাবহ দিন। |
 |
|
এ
দিন নাটুদহের কাছে বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্থানি বাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে
পিন্টু, হাসান, খোকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, তারিক ও আফাজউদ্দিন নামে ৮জন বীর
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদেরকে জগন্নাথপুর গ্রামের দুটি কবরে দাফন করা হয়
যা এখন আটকবর নামে পরিচিত। এছাড়াও ৭ আগস্ট জীবননগর থানার ধোপাখালি
সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্থানি বাহিনীর মধ্যে এক
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়।
সেপ্টেম্বর
মাসে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে লেঃ কর্নেল আবুল মনজুর দায়িত্ব নেন।
তিনি যুদ্ধ বেগবান করা ও বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনেন।
যুদ্ধ এগিয়ে যায় চুড়ান্ত বিজয়ের দিকে। ২৬ নভেম্বর পাকিস্থানি বাহিনীকে
হটিয়ে দিয়ে জীবননগর পুর্নদখলে করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা
হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় দর্শনা, ৭ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা,
সর্বোপরি ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্থানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সারা দেশ।
বিশ্বের মানচিত্রে পথ চলতে শুরু করে বাংলাদেশ নামক দেশটি ।
|
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন