রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১২

ঢাকা-কোলকাতা ট্রেন এখন বন্ধুত্বের প্রতীক

কোলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেনে যেতে দশ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে ৷ এক সময়, এই রুটটি শরণার্থীতে ঠাসা ছিল ৷ আজ, এই রুটে চলছে মৈত্রী (“বন্ধুত্ব”) এক্সপ্রেস৷

  • জনপ্রিয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে অপেক্ষা করছে ৷ ভারতীয় এই ট্রেনটি মঙ্গলবারে কোলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে এবং পরের দিন ফিরে যায়৷ [কে.আর. চৌধুরী/খবর] জনপ্রিয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে অপেক্ষা করছে ৷ ভারতীয় এই ট্রেনটি মঙ্গলবারে কোলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে এবং পরের দিন ফিরে যায়৷ কাজী শামসু জামান এখন বাংলাদেশের নাগরিক, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পেতে ট্রেনে করে কোলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসেন৷ ২০০৮ সালে, মৈত্রী এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী যাত্রায় তিনি একই পথে একজন পর্যটক হিসেবে ভ্রমণ করেন৷ [কে.আর. চৌধুরী/খবর]
  • কাজী শামসু জামান এখন বাংলাদেশের নাগরিক, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পেতে ট্রেনে করে কোলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসেন৷ ২০০৮ সালে, মৈত্রী এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী যাত্রায় তিনি একই পথে একজন পর্যটক হিসেবে ভ্রমণ করেন৷ ভারতীয় নাগরিক মনি দীপা শীল, তার স্বামী অয়ন সরকার ও ছেলে নভোনীল মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে ঢাকা থেকে কলকোতা যাওয়ার সময় ছবি তোলার জন্য পোজ দেন৷ [কে.আর. চৌধুরী/খবর]
  • ভারতীয় নাগরিক মনি দীপা শীল, তার স্বামী অয়ন সরকার ও ছেলে নভোনীল মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে ঢাকা থেকে কলকোতা যাওয়ার সময় ছবি তোলার জন্য পোজ দেন৷ [কে.আর. চৌধুরী/খবর]
 
বাংলাদেশের একজন নাগরিক কাজী শামসু জামান, ৭৪, সেই ইতিহাসের একজন সাক্ষী ৷
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যকার অবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়া সহিংসতা ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে জামানের পরিবারকে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য করে, তাদেরকে তাদের শতাব্দী প্রাচীন বসতবাড়ি ফেলে চলে আসতে হয় ৷
সেই মাসে, ব্রিটেন কর্তৃক ভারত দুইটি দেশে বিভক্ত হবার পর, পাকিস্তানের বেশিরভাগ হিন্দু ভারতে চলে যায়, অন্যদিকে অনেক ভারতীয় মুসলমান নতুন করে পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করে ৷ জামান ছিলেন সেই দলবদ্ধ প্রস্থানকারীদের একজন, এবং এর সাথে জড়িত ভয়ঙ্কর সহিংসতার একজন সাক্ষী ৷

ট্রেনে করে সহিংসতা থেকে পালিয়া আসা
তিনি ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ভয়াবহ ঘটনাগুলো এখনো মনে করতে পারেন, যখন একটি নৃশংস হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ মারা যায়৷ তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর৷
“১৯৪৬ সালে, হিন্দুরা আমাদের হাওড়ার শিবপুরের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, তখন হিন্দু ও মুসলমানরা তাদের শক্তি দেখানোর জন্য সাম্প্রদায়িক সংঘাতে লিপ্ত ছিল,” খবর দক্ষিণ এশিয়াকে বলেছেন জামান ৷ “আমি নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ভর্তি একটি ছোট ব্যাগ সাথে নিয়ে একটি আপেল গাছের উপর লুকিয়ে ছিলাম৷ আমি যে গাছের উপর লুকিয়েছিলাম তার নিচে একটি কবরের ভেতরে লুকিয়ে থেকে আমার বাবা বেঁচে যান”৷
তিনি বলেন, “সেই দিন, আমি ও আমাদের আরো কয়েকজন মুসলমান স্বজন মিলে কাছের একটি কয়লার স্তুপে কমপক্ষে ১৭টি লাশ কবর দিই”৷
১৯৪৭ সালের ১৩ই অগাস্টে অপরিচিত ঢাকায় আসার আগে পর্যন্ত সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের বাবা-মা মুসলমান-অধ্যুষিত বারাসাত এলাকায় ছিলেন, যা তৎকালে কোলকাতার অধীনে ছিল৷
ঢাকা-কোলকাতা ট্রেনে চড়ার জন্য তাদেরকে কয়েকদিন হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, এই ট্রেনে করে লক্ষ লক্ষ লোককে পরিবহন করা হয় যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে পালিয়ে আসছিলেন ৷
“এই ট্রেন ভর্তি হয়ে হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে সাধারণত কোলকাতা আগমন করতো, এবং ভারত থেকে ট্রেন ভর্তি হয়ে মুসলমানদেরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতো,” বলেছেন জামান৷ “যেহেতু এই দুটি শহরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ খুব একটা ভালো ছিল না, তাই প্রচুর মানুষকে স্থানান্তরের জন্য ট্রেন অনেক সাহায্য করেছে”৷
১৯৫২ সালে, তিনি এই পথে আবারো ভ্রমণ করেন, তখন তার সাথে তার একজন চাচা ছিলেন যিনি অবশেষে কোলকাতা ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন ৷ তিনি মনে করেছিলেন সেটাই ছিল এই পথে তার শেষ যাত্রা৷
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে এই পথটি বন্ধ করে দেয়া হয়৷ এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরেও, এই পথে ট্রেন চলাচাল পুনরায় চালু করা হয়নি৷
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে এই রুটটি বন্ধ করে দেয়ার পর কয়েক দশক ধরে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ছিল, খবরকে বলেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর) এর সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী আসাদুল্লাহ৷

একটি রুটের পুনর্জন্ম
২০০৮ সালের ১৪ই এপ্রিল তারিখে, ভারত ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অবশেষে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এবং মৈত্রী এক্সপ্রেস নাম দিয়ে এই ট্রেন সার্ভিস চালু করে, যা সরাসরি ঢাকা ও কোলকাতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে ৷
এই পথে তার সর্বশেষ যাত্রার ৫৬ বছর পরে উদ্বোধনী ট্রিপে অংশ নেয়ার জন্য জামান সেখানে উপস্থিত ছিলেন ৷ তখন তার ৪০ বছর বয়সী মেয়ে মুনিমা সুলতানা তার সাথে ছিলেন৷
“আমি উদ্বোধনী দিনে ভ্রমণ করেছি কারণ আমি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-কোলকাতা ট্রেন সার্ভিস পুনঃস্থাপনের আশা নিয়ে ছিলাম,” ট্রিপটি সম্পর্কে বলেছেন তিনি, যেটিকে তিনি “সত্যিই আবেগময়” বলে বর্ণনা করেছেন৷
তিনি বলেন, “আমি ১৯৫২ সালে একটি বালক হিসেবে ট্রেনে করে ভ্রমণ করেছিলাম, কিন্তু এখন আমি পর্যটক হিসেবে আমার মেয়েকে নিয়ে ভ্রমণ করেছি”৷
যাত্রীর অভাবে রুটটি প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল৷ রেলওয়ের রেকর্ডে দেখা গেছে যে ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ট্রেনটির প্রতিবারের যাত্রায় ৪১৮-আসনের ট্রেনে গড়ে মাত্র ৬৫ জন যাত্রী ছিল - যা ছিল উভয় সরকারের জন্য অস্বস্তিকর ৷
সীমান্তে অপেক্ষার সময় চার ঘন্টা থেকে কমিয়ে আড়াই ঘন্টায় নিয়ে আসার ফলে যাত্রীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় ৷ এছাড়াও কর্তৃপক্ষ আসন সংখ্যা কমিয়ে আনে, বর্তমানে ৩২৬টি আসন রয়েছে ৷ নতুন করে এর জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো এর যুক্তিসঙ্গত ভাড়া - এক পথে ৮, ১২ ও ২০ ডলার ৷
“ট্রেনটি এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় ৷ এখন এর সবগুলো আসন ভর্তি থাকে,” খবরকে বলেছেন বিআর-এর ট্রাফিক পরিচালক সৈয়দ জহুরুল ইসলাম৷

মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে বাংলাদেশি ট্রেন ঢাকা থেকে কোলকাতার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং পরের দিন ফিরে আসে৷ ভারতীয় ট্রেন মঙ্গলবারে কোলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে এবং পরের দিন ফিরে যায়৷
২৮ অগাস্ট তারিখে ভারতীয় নাগরিক মনি দীপা শীল এবং তার স্বামী অয়ন সরকার তাদের ছেলে নভোনীলকে নিয়ে প্রথম বারের মত ট্রেনে করে ঢাকা আসেন কুমিল্লায় বসবাসকারী তাদের একজন মামার সাথে দেখা করার জন্য, যা রাজধানী থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত৷
“মৈত্রী এক্সপ্রেস বাংলাদেশে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করাটা সহজ করে তুলেছে, তাই এই ধরনের আরো ট্রেন চালু করা উচিত,” ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার আগে খবরকে বলেছেন শীল ৷ “ট্রেনে যাতায়াত করাটা বাসের চেয়ে বেশি আরামদায়ক”৷
তাইওয়ানের ছাত্র চেন আন্নি ঢাকা ও কোলকাতায় তার বন্ধুদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য এই ট্রেনটি ব্যবহার করেন এবং তিনি বলেছেন যে, পর্যটনে সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত এ ধরনের আরো ট্রেনের ব্যবস্থা করা ৷
সহযাত্রী নিশি রঞ্জন তালুকদার, বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, একমত পোষণ করেন৷ তার স্ত্রীকে নিয়ে তিনিও ২৮শে সেপ্টেম্বরের ট্রেনে চড়েছিলেন তার ভাই ও বোনদেরকে দেখার উদ্দেশ্যে৷
“আরো বেশি ট্রেন এই দুই দেশের মানুষদের মধ্যে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করবে এবং মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়াবে,” বলেছেন তালুকদার ৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপরে ফিরে আসুন Blogger Widgets